সোমবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১০

আন্দালুসিয়া থেকে - ১

কিছুটা ঝোঁকের মাথায় এক রাতের মাঝেই সবকিছু ঠিক করে ফেললাম। কিছুটা অভিমান থেকে কী কারো প্রতি? হয়তো বা হয়তো নয়। সে যাই হোক, এখন শুনেন সেই গল্প। এই যে, তোমাকেও বলছি; শোন।

বড়দিনের ছুটিতে স্পেনের দক্ষিণভাগে যাবো। ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেঁষা মালাগা থেকেই শুরু করবো আন্দালুসিয়া ভ্রমণ। আন্দালুসিয়া স্পেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। অষ্টম থেকে পঞ্চদশ শতকের প্রায় শেষ পর্যন্ত এই অঞ্চলের অনেকখানিই ছিল মুসলিমদের শাসনাধীন।

২৬ তারিখে যাত্রা শুরু, আইন্দহোফেন থেকে। আমি চলে এসেছিলাম এক দিন আগেই। তানবীরা আপুর একমাত্র কন্যা ও সন্তান আমাদের মেঘলা মা'র জন্মদিন পালন করতে। রাতটা আপুর বাসাতেই কাটিয়ে, সকালের ভরপেট নাস্তা আর দুপুরে বিরিয়ানী খেয়ে যখন বের হলাম তখন একটা চকচকে দুপুর চারদিকে সোনা রোদ ছড়িয়ে দিচ্ছে। সত্যি বলতে এই দেশে, এই সময় এরকম ঝলমলে দিন সোনার মতই দামী।

আমি প্রায়ই হালকা বেকুব টাইপ কাজ করি। এবারও তার ব্যত্যয় হলো না। রাস্তার যে পাশ থেকে বাসে ঊঠতে হবে সে পাশে না যেয়ে বিপরীত পাশে চলে গেলাম। অবশ্য খুব সহসাই ভুল বুঝতে পেরে আবার বাক্স-পেটরা নিয়ে ওপারে। এরপরে এয়ারপোর্টে এসে বাকি সব কাজ সহজেই হলো। ভয় ছিল ক্ষীণ মনে আবহাওয়ার কারণে। কিন্তু এমন চমৎকার একটা দিনের কারণে আকাশে উড়লাম ঠিক সময়েই ট্রান্সাভিয়ায় চড়ে।

কিছুটা ঘুম আর বাকিটা সময় টয় স্টোরি ৩ দেখতে দেখতেই পার হয়ে গেলো। পৌঁছে গেলাম মালাগায় নির্ধারিত সময়ের প্রায় ২০ মিনিট আগেই।

এয়ারপোর্টের বিপরীতেই ট্রেন স্টেশন। আমি যেই হোস্টেলে উঠেছি সেখানে ট্রেন-বাসে করেও যাওয়া যায়। আবার এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি বাসও আছে। প্রথমে ট্রেন আর বাসে করে গেলে অবশ্য হোস্টেলের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া যায়। তাই ট্রেনের টিকিট কেটে অপেক্ষা করতে লাগলাম এবং ট্রেন আসার ঠিক এক মিনিট আগে শুনতে পেলাম লাউড স্পীকারে অবশ্যই স্পেনিশ ভাষায় এক ঘোষণা। এই ক্রিয়ার বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখলাম লোকজন সবাই ট্রেন স্টেশন ছেড়ে বাসের দিকে হাঁটা দিল। একজনকে 'ওলা' বলে থামিয়ে ইংরেজীতে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম সাময়িক কিছু সময়ের জন্য ট্রেন যাবে না ওদিকে। সুতরাং, বাসই ভরসা এখন।

বাস যেখানে নামিয়ে দিল জায়গাটার নাম 'পাসেও দেল পার্কে'। কিভাবে হোস্টেলে পৌঁছতে হবে এখান থেকে সেই নির্দেশনা আছে কিন্তু কোন ম্যাপ নেই। একজন চমৎকার ভদ্রমহিলাকে থামিয়ে প্রথমে কোন দিকে যেতে হবে জেনে নিলাম। আর তাকে দিলাম পুরোটুকু 'গ্রাসিয়াস'।

এরপরে চলতে চলতেই একসময় পেয়ে গেলাম 'পিকাসা'স কর্ণার'। এখানেই কাটবে আমার আগামী তিনটা রাত। রিসেপশনে বসা 'দিমি' রুম বুঝিয়ে দিল আর তার পাওনা টাকাও বুঝে নিল। একজনের ছোট্ট, ছিমছাম রুম। তবে শব্দ অনেক কারণ একেবারেই সদর দরজার গা ঘেঁষে বলে।

একটু হাত-মুখে পানি দিয়েই বেরিয়ে পড়লাম চারপাশটা দেখতে। দারুণ আবহাওয়া। তাপমাত্রা ১২-১৫ এর মধ্যেই হবে মনে হয়। হালকা ঝিরিঝিরি বাতাস আর তার সাথে ঝিলমিল করতে থাকা বালিকারা ভ্রমণের ক্লান্তিকে দূর করে দিল প্রায়। প্রায় লিখলাম একটা কারণে। সভ্য সমাজে প্রকাশ্যে বলা যাবে না। প্রাইভেটে আসেন, বলব; তবে এখানেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে।

হোস্টেল থেকে একেবারে কাছেই একটা ঢাল ধরে হাঁটতে হাঁটতেই চোখে পড়ল উঁচু উঁচু দেয়াল। বুঝে গেলাম এই হল 'আল-কাজাবা'। একাদশ শতাব্দীতে মুসলিম শাসকদের নির্মিত এক দুর্গ। ভিতরের ছবি ইন্টারনেটে দেখেছি। রাত হয়ে যাওয়ায় এখন আর ঢুকতে পারলাম না। দিনের বেলা কোন একদিন আসতে হবে।



আল কাজাবার পাশ দিয়ে পাহাড়ের ঢালে উঁচু-নিচু হয়ে চলে গেছে দেয়ালসহ এক লম্বা রাস্তা। আল-কাজাবাকে শত্রুদের হাত থেকে সুরক্ষিত করতেই তৎকালীন গ্রানাডার শাসক ইউসুফ বানিয়েছিলেন এই পথ যার নাম 'জিব্রালফারো'। মাঝেমাঝে থেমে বন্দী করে নিলাম পাহাড়ের উপর থেকে দেখা শহরটাকে। শুনেছি এই পথের কোন এক প্রান্তেই আছে এক বাতিঘর। আজ অতদূর যাইনি; যেতে হবে পরে একদিন।



ঘুরতে ফিরতেই দেখছিলাম অনেকগুলো দলকে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে অথবা হয়তো শুধু দু'জন আলাদা হয়ে যেয়ে আলো-আঁধারীতে বসে আছে। ছায়া পড়েনি ওদের আলাদা করে মাটিতে। আমি অন্যদিকে তাকিয়ে হেঁটে যাই আর ওরা আরও ঘন হয়ে আসে একজন অন্যজনের দিকে। পৃথিবী এক নিষ্ঠুর জায়গা।

কাল সকালে যাবো করডোবা। মালাগা থেকে দেড় ঘন্টার ট্রেন যাত্রা। ওখানেও শুনেছি আছে রোমান আর মুসলিমদের অনেক স্থাপত্য নিদর্শন। সাথে থাকুন, ঘুরে আসি চলুন কাল করডোবা থেকে।


.................................
মালাগা থেকে
রাত ১টা ২০
২৭ ডিসেম্বর, ২০১০

কোন মন্তব্য নেই: