বুধবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১০

আন্দালুসিয়া থেকে - ২

টেরই পেলাম না কিভাবে ৩টা দিন চলে গেল। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, গত তিন দিনের কথা মনে করলেই কোন মূহুর্তটা চোখের সামনে ভাসে তবে আমি বলবো পাহাড়ের ঢাল ধরে কুঁজো হয়ে উপরে উঠছি যেন কোন পরমা সুন্দরী আমার জন্য চূড়ায় বসে অপেক্ষা করছে। সুন্দরী অনেকেই ছিল উপরে তবে তাদের কেউই আমার জন্য ছিল না। আমার জন্য ছিল পুরোনো, শ্যাওলা ধরা দেয়াল আর দেয়ালের ভিতরে আগের দিনের রাজা-বাদশাহদের বাগানবাড়ি আর দূর্গ। আমার কাছে দুধ থেকে ঘোল উত্তম।

২৭ ডিসেম্বরঃ
---------------------------------------------------
এখানে ভোরবেলায় কাক ডাকে কিনা জানি না, তবে আমাকে উঠতেই হল অনেক সকালে। সূর্য তখন উঠি উঠি করছে। ব্যাগপ্যাক কাঁধে আর গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে ঠিক বাস স্টপটাতে গিয়েই দাঁড়ালাম। গন্তব্য ট্রেন স্টেশন। করডোবা যাচ্ছি ট্রেনে।

মালাগা থেকে ১৫০ কিমি দূরত্ব ট্রেনে পাড়ি দিতে সময় লাগে ১ ঘন্টা ১০ মিনিট। ডাচ ট্রেনগুলোর এদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। আর এই ট্রেনে চড়ে আপনারও কিন্তু ঘুমিয়ে থাকলে চলবে না। চেষ্টা করুন বসতে জানালার পাশে আর চোখ খোলা রাখুন। প্রকৃতি আপনার চোখ জুড়িয়ে দেবে। কিছু'খন পরপরই পাহাড় আর উপত্যকা ধরা দেবে জানালার পাশে। ডিসেম্বরের শেষভাগে এসেও চারদিকে অনেক সবুজ। এবার নিন, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটান আর বলুন দুধ অপেক্ষা ঘোল উত্তম।

 
বেশ বাতাস বইছিল যখন নামি করডোবাতে। ট্রেন স্টেশনের ভিতরেই ট্যুরিসমের কাউন্টার। জেনে নিলাম বাস নম্বর যাওয়ার, করডোবার বিখ্যাত ক্যাথেড্রাল-মস্কে। মুসলিম শাসনাধীন সময়ে এর মূল নির্মাণ আর পরে খ্রিষ্টানরা কর্তৃত্ব নিয়ে সূচনা করে ক্যাথেড্রালের। সামনের চত্বর ঘিরে রয়েছে কমলা বাগান। চটপট কয়েকটা ছবি তুলে টিকিট কেটে ভিতরে এসে ঢুকলাম। সারি সারি, ক্যাথেড্রালের ছাদ ছোঁয়া কারুকর্যময় পিলার আর ততোধিক সুন্দর ক্যাথেড্রালের নকশা-খচিত ছাদ। অনেক প্যাভিলিয়ন আছে ভেতরে। ইতিহাসবিদ নই তাছাড়াও অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি বিশেষ পছন্দ নয় বিধায় আমি শুধু ছবিই তুলে গেলাম। প্রার্থনার মূল বেদীর সামনে যেয়ে চোখ ছানাবড়া। Freaking Gorgeous. একথাটাই বলে ছিলাম তখন। এরপরে আরো অনেকবারই বলেছি মনে হয়।



পুরো বর্ণনা দিয়ে ঘোলটাকে দুধ বানিয়ে দিতে চাই না। শুধু বলব, একবার ঘুরে আসুন।

ক্যাথেড্রাল থেকে বেরিয়ে গেলাম রোমানদের বানানো এক সেতু দেখতে। সেতুর মাথায় এক বিশাল টাওয়ার যেমনটা দেখতে পাওয়া যায় Age of Empires গেমে। নাম ভুলে গেছি এই প্রাচীন স্থাপত্যের। ধরে নেন টাওয়ার অফ হ্যানয়।


এই ফাঁকেই আবার বেকুব টাইপ একটা কাজ করলাম। বুড়িমতন এক মহিলা আমার দিকে ফুল বাড়িয়ে ধরল। আমি ভাবলাম, তরুণী না হোক অসুবিধা কী; আর তাছাড়া ফুল না নিলে মনে কষ্ট পাবেন। এই ভেবে যেই হাত বাড়ালাম উনি খপ করে আমার হাত ধরে ভাগ্য গণনা শুরু করে দিলেন। প্রথমেই বললেন আমি খুব বুদ্ধিমান; আমি মনে মনে বলি, "হ। খুউব বুদ্ধিমান। তাইতো এখন আমার হাত তোমার কাছে"। শুধু ভালো ভালো কথাই শুনলাম। খারাপ কিছু বলল না। পাঁচটি ইউরো খসে গেল।

করডোবার রাস্তাগুলো আমাদের পুরোনো ঢাকার রাস্তার থেকেও সরু। ঐ গলিগুলোতে আবার গাড়িও যায়। এরকম চিপা চাপায় ঘুরতে থাকলাম। খিদে মেটালাম পায়েইয়া (বাঙালী উচ্চারণঃ পায়েলা) খেয়ে। তারপর ঠিক করলাম শহরের অন্য প্রান্তে যাবো। ওলা বলে লোক থামানো শুরু করলাম। সবার এক কথা "তরেতো", মানে সোজা রাস্তায় যাও। যেতে যেতে ভাবতে থাকলাম পা দুটো খুলে হাতে নিয়ে হাঁটতে পারলে ভালো লাগতো।

অবশেষে পৌঁছলাম। এদিকে শুধুই পুরোনো চার্চ। খানিক সময় ছবি তুলে উঠে পড়লাম। এবারের গন্তব্য ট্রেন স্টেশন। ফিরতি ট্রেন ধরতে হবে। বাঁধালাম দ্বিতীয় বিপত্তি। অনেকক্ষণ ধরে ম্যাপ স্টাডি করার ফলাফল হল যেখানে দুপুরের খাবার খেয়েছিলাম সেখানেই ফেরত আসলাম। ভাগ্যিস হাতে অনেক সময় ছিল। এইবার হাঁটা বাদ আর হাঁটার মত কোন শক্তিও অবশিষ্ট ছিল না। বাসে চড়ে বসলাম।

স্টেশনে এসে দেখি যেই ট্রেনের টিকিট ছিল সেই ট্রেন আসতে এক ঘন্টা দেরি হবে। গেলাম কাউন্টারে, ২০ মিনিট পরের ট্রেনে টিকিট পরিবর্তন করে নিতে কারণ ওটা ঠিক সময়েই আসবে। কাউন্টার থেকে বলা হল চেঞ্জ করার জন্য যেই ট্রেনে করে এসেছি সেটার টিকিট লাগবে। ব্যাগের আর নিজের দেহের চিপায়-চাপায় খুঁজেও যখন পেলাম না তখন নিজেকে গালি দেওয়ার শক্তিটুকুও নেই।

প্রায় ১০ মিনিট পরে হঠাৎ করেই 'ইউরেকা, ইউরেকা' বলে লাফিয়ে উঠলাম। টিকিট রাখা ছিল জ্যাকেটের গোপন পকেটে যেটার কথা আমিই ভুলে বসে ছিলাম। টিকিট চেঞ্জ করে ঠিক সময়মতন উঠে বসলাম মালাগার ফিরতি ট্রেনে।

এখানেই শেষ নয়। ফেরার পর মালাগার শপিং মলগুলো খানিক ঘুরে যখন ঠিক করলাম এইবার বাড়ির পথ ধরি আর বাস স্টপ খুঁজে পাই না। যেগুলো পাই সেগুলো থেকে ঐদিকে কোন বাস যায় না। আমার কোন দোষ নাই। এর কারণ স্পেনের অনেক রাস্তাতেই একদিকে চলাচল। যার ফলে বাস যেদিক থেকে আসে, সেদিক থেকে নাও যেতে পারে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে পেলাম। আর সেই বাস ঘন্টায় একটা।

আপনাদের আর বসিয়ে রাখবো না আমার সাথে। আমিও এত্তকিছুর পরে অনেক ক্লান্ত। সাথে আনা নাপা খুব কাজে দিচ্ছে। মালাগার গল্পই তো শোনানো হল না। হবে আরেকদিন। আজ যাই।

--------------------
গ্রানাডা থেকে


রাত ১০টা ৩০
২৯ ডিসেম্বর

সোমবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১০

আন্দালুসিয়া থেকে - ১

কিছুটা ঝোঁকের মাথায় এক রাতের মাঝেই সবকিছু ঠিক করে ফেললাম। কিছুটা অভিমান থেকে কী কারো প্রতি? হয়তো বা হয়তো নয়। সে যাই হোক, এখন শুনেন সেই গল্প। এই যে, তোমাকেও বলছি; শোন।

বড়দিনের ছুটিতে স্পেনের দক্ষিণভাগে যাবো। ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেঁষা মালাগা থেকেই শুরু করবো আন্দালুসিয়া ভ্রমণ। আন্দালুসিয়া স্পেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। অষ্টম থেকে পঞ্চদশ শতকের প্রায় শেষ পর্যন্ত এই অঞ্চলের অনেকখানিই ছিল মুসলিমদের শাসনাধীন।

২৬ তারিখে যাত্রা শুরু, আইন্দহোফেন থেকে। আমি চলে এসেছিলাম এক দিন আগেই। তানবীরা আপুর একমাত্র কন্যা ও সন্তান আমাদের মেঘলা মা'র জন্মদিন পালন করতে। রাতটা আপুর বাসাতেই কাটিয়ে, সকালের ভরপেট নাস্তা আর দুপুরে বিরিয়ানী খেয়ে যখন বের হলাম তখন একটা চকচকে দুপুর চারদিকে সোনা রোদ ছড়িয়ে দিচ্ছে। সত্যি বলতে এই দেশে, এই সময় এরকম ঝলমলে দিন সোনার মতই দামী।

আমি প্রায়ই হালকা বেকুব টাইপ কাজ করি। এবারও তার ব্যত্যয় হলো না। রাস্তার যে পাশ থেকে বাসে ঊঠতে হবে সে পাশে না যেয়ে বিপরীত পাশে চলে গেলাম। অবশ্য খুব সহসাই ভুল বুঝতে পেরে আবার বাক্স-পেটরা নিয়ে ওপারে। এরপরে এয়ারপোর্টে এসে বাকি সব কাজ সহজেই হলো। ভয় ছিল ক্ষীণ মনে আবহাওয়ার কারণে। কিন্তু এমন চমৎকার একটা দিনের কারণে আকাশে উড়লাম ঠিক সময়েই ট্রান্সাভিয়ায় চড়ে।

কিছুটা ঘুম আর বাকিটা সময় টয় স্টোরি ৩ দেখতে দেখতেই পার হয়ে গেলো। পৌঁছে গেলাম মালাগায় নির্ধারিত সময়ের প্রায় ২০ মিনিট আগেই।

এয়ারপোর্টের বিপরীতেই ট্রেন স্টেশন। আমি যেই হোস্টেলে উঠেছি সেখানে ট্রেন-বাসে করেও যাওয়া যায়। আবার এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি বাসও আছে। প্রথমে ট্রেন আর বাসে করে গেলে অবশ্য হোস্টেলের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া যায়। তাই ট্রেনের টিকিট কেটে অপেক্ষা করতে লাগলাম এবং ট্রেন আসার ঠিক এক মিনিট আগে শুনতে পেলাম লাউড স্পীকারে অবশ্যই স্পেনিশ ভাষায় এক ঘোষণা। এই ক্রিয়ার বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখলাম লোকজন সবাই ট্রেন স্টেশন ছেড়ে বাসের দিকে হাঁটা দিল। একজনকে 'ওলা' বলে থামিয়ে ইংরেজীতে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম সাময়িক কিছু সময়ের জন্য ট্রেন যাবে না ওদিকে। সুতরাং, বাসই ভরসা এখন।

বাস যেখানে নামিয়ে দিল জায়গাটার নাম 'পাসেও দেল পার্কে'। কিভাবে হোস্টেলে পৌঁছতে হবে এখান থেকে সেই নির্দেশনা আছে কিন্তু কোন ম্যাপ নেই। একজন চমৎকার ভদ্রমহিলাকে থামিয়ে প্রথমে কোন দিকে যেতে হবে জেনে নিলাম। আর তাকে দিলাম পুরোটুকু 'গ্রাসিয়াস'।

এরপরে চলতে চলতেই একসময় পেয়ে গেলাম 'পিকাসা'স কর্ণার'। এখানেই কাটবে আমার আগামী তিনটা রাত। রিসেপশনে বসা 'দিমি' রুম বুঝিয়ে দিল আর তার পাওনা টাকাও বুঝে নিল। একজনের ছোট্ট, ছিমছাম রুম। তবে শব্দ অনেক কারণ একেবারেই সদর দরজার গা ঘেঁষে বলে।

একটু হাত-মুখে পানি দিয়েই বেরিয়ে পড়লাম চারপাশটা দেখতে। দারুণ আবহাওয়া। তাপমাত্রা ১২-১৫ এর মধ্যেই হবে মনে হয়। হালকা ঝিরিঝিরি বাতাস আর তার সাথে ঝিলমিল করতে থাকা বালিকারা ভ্রমণের ক্লান্তিকে দূর করে দিল প্রায়। প্রায় লিখলাম একটা কারণে। সভ্য সমাজে প্রকাশ্যে বলা যাবে না। প্রাইভেটে আসেন, বলব; তবে এখানেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে।

হোস্টেল থেকে একেবারে কাছেই একটা ঢাল ধরে হাঁটতে হাঁটতেই চোখে পড়ল উঁচু উঁচু দেয়াল। বুঝে গেলাম এই হল 'আল-কাজাবা'। একাদশ শতাব্দীতে মুসলিম শাসকদের নির্মিত এক দুর্গ। ভিতরের ছবি ইন্টারনেটে দেখেছি। রাত হয়ে যাওয়ায় এখন আর ঢুকতে পারলাম না। দিনের বেলা কোন একদিন আসতে হবে।



আল কাজাবার পাশ দিয়ে পাহাড়ের ঢালে উঁচু-নিচু হয়ে চলে গেছে দেয়ালসহ এক লম্বা রাস্তা। আল-কাজাবাকে শত্রুদের হাত থেকে সুরক্ষিত করতেই তৎকালীন গ্রানাডার শাসক ইউসুফ বানিয়েছিলেন এই পথ যার নাম 'জিব্রালফারো'। মাঝেমাঝে থেমে বন্দী করে নিলাম পাহাড়ের উপর থেকে দেখা শহরটাকে। শুনেছি এই পথের কোন এক প্রান্তেই আছে এক বাতিঘর। আজ অতদূর যাইনি; যেতে হবে পরে একদিন।



ঘুরতে ফিরতেই দেখছিলাম অনেকগুলো দলকে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে অথবা হয়তো শুধু দু'জন আলাদা হয়ে যেয়ে আলো-আঁধারীতে বসে আছে। ছায়া পড়েনি ওদের আলাদা করে মাটিতে। আমি অন্যদিকে তাকিয়ে হেঁটে যাই আর ওরা আরও ঘন হয়ে আসে একজন অন্যজনের দিকে। পৃথিবী এক নিষ্ঠুর জায়গা।

কাল সকালে যাবো করডোবা। মালাগা থেকে দেড় ঘন্টার ট্রেন যাত্রা। ওখানেও শুনেছি আছে রোমান আর মুসলিমদের অনেক স্থাপত্য নিদর্শন। সাথে থাকুন, ঘুরে আসি চলুন কাল করডোবা থেকে।


.................................
মালাগা থেকে
রাত ১টা ২০
২৭ ডিসেম্বর, ২০১০