টেরই পেলাম না কিভাবে ৩টা দিন চলে গেল। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, গত তিন দিনের কথা মনে করলেই কোন মূহুর্তটা চোখের সামনে ভাসে তবে আমি বলবো পাহাড়ের ঢাল ধরে কুঁজো হয়ে উপরে উঠছি যেন কোন পরমা সুন্দরী আমার জন্য চূড়ায় বসে অপেক্ষা করছে। সুন্দরী অনেকেই ছিল উপরে তবে তাদের কেউই আমার জন্য ছিল না। আমার জন্য ছিল পুরোনো, শ্যাওলা ধরা দেয়াল আর দেয়ালের ভিতরে আগের দিনের রাজা-বাদশাহদের বাগানবাড়ি আর দূর্গ। আমার কাছে দুধ থেকে ঘোল উত্তম।
২৭ ডিসেম্বরঃ
---------------------------------------------------
এখানে ভোরবেলায় কাক ডাকে কিনা জানি না, তবে আমাকে উঠতেই হল অনেক সকালে। সূর্য তখন উঠি উঠি করছে। ব্যাগপ্যাক কাঁধে আর গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে ঠিক বাস স্টপটাতে গিয়েই দাঁড়ালাম। গন্তব্য ট্রেন স্টেশন। করডোবা যাচ্ছি ট্রেনে।
মালাগা থেকে ১৫০ কিমি দূরত্ব ট্রেনে পাড়ি দিতে সময় লাগে ১ ঘন্টা ১০ মিনিট। ডাচ ট্রেনগুলোর এদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। আর এই ট্রেনে চড়ে আপনারও কিন্তু ঘুমিয়ে থাকলে চলবে না। চেষ্টা করুন বসতে জানালার পাশে আর চোখ খোলা রাখুন। প্রকৃতি আপনার চোখ জুড়িয়ে দেবে। কিছু'খন পরপরই পাহাড় আর উপত্যকা ধরা দেবে জানালার পাশে। ডিসেম্বরের শেষভাগে এসেও চারদিকে অনেক সবুজ। এবার নিন, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটান আর বলুন দুধ অপেক্ষা ঘোল উত্তম।
বেশ বাতাস বইছিল যখন নামি করডোবাতে। ট্রেন স্টেশনের ভিতরেই ট্যুরিসমের কাউন্টার। জেনে নিলাম বাস নম্বর যাওয়ার, করডোবার বিখ্যাত ক্যাথেড্রাল-মস্কে। মুসলিম শাসনাধীন সময়ে এর মূল নির্মাণ আর পরে খ্রিষ্টানরা কর্তৃত্ব নিয়ে সূচনা করে ক্যাথেড্রালের। সামনের চত্বর ঘিরে রয়েছে কমলা বাগান। চটপট কয়েকটা ছবি তুলে টিকিট কেটে ভিতরে এসে ঢুকলাম। সারি সারি, ক্যাথেড্রালের ছাদ ছোঁয়া কারুকর্যময় পিলার আর ততোধিক সুন্দর ক্যাথেড্রালের নকশা-খচিত ছাদ। অনেক প্যাভিলিয়ন আছে ভেতরে। ইতিহাসবিদ নই তাছাড়াও অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি বিশেষ পছন্দ নয় বিধায় আমি শুধু ছবিই তুলে গেলাম। প্রার্থনার মূল বেদীর সামনে যেয়ে চোখ ছানাবড়া। Freaking Gorgeous. একথাটাই বলে ছিলাম তখন। এরপরে আরো অনেকবারই বলেছি মনে হয়।
পুরো বর্ণনা দিয়ে ঘোলটাকে দুধ বানিয়ে দিতে চাই না। শুধু বলব, একবার ঘুরে আসুন।
ক্যাথেড্রাল থেকে বেরিয়ে গেলাম রোমানদের বানানো এক সেতু দেখতে। সেতুর মাথায় এক বিশাল টাওয়ার যেমনটা দেখতে পাওয়া যায় Age of Empires গেমে। নাম ভুলে গেছি এই প্রাচীন স্থাপত্যের। ধরে নেন টাওয়ার অফ হ্যানয়।
এই ফাঁকেই আবার বেকুব টাইপ একটা কাজ করলাম। বুড়িমতন এক মহিলা আমার দিকে ফুল বাড়িয়ে ধরল। আমি ভাবলাম, তরুণী না হোক অসুবিধা কী; আর তাছাড়া ফুল না নিলে মনে কষ্ট পাবেন। এই ভেবে যেই হাত বাড়ালাম উনি খপ করে আমার হাত ধরে ভাগ্য গণনা শুরু করে দিলেন। প্রথমেই বললেন আমি খুব বুদ্ধিমান; আমি মনে মনে বলি, "হ। খুউব বুদ্ধিমান। তাইতো এখন আমার হাত তোমার কাছে"। শুধু ভালো ভালো কথাই শুনলাম। খারাপ কিছু বলল না। পাঁচটি ইউরো খসে গেল।
করডোবার রাস্তাগুলো আমাদের পুরোনো ঢাকার রাস্তার থেকেও সরু। ঐ গলিগুলোতে আবার গাড়িও যায়। এরকম চিপা চাপায় ঘুরতে থাকলাম। খিদে মেটালাম পায়েইয়া (বাঙালী উচ্চারণঃ পায়েলা) খেয়ে। তারপর ঠিক করলাম শহরের অন্য প্রান্তে যাবো। ওলা বলে লোক থামানো শুরু করলাম। সবার এক কথা "তরেতো", মানে সোজা রাস্তায় যাও। যেতে যেতে ভাবতে থাকলাম পা দুটো খুলে হাতে নিয়ে হাঁটতে পারলে ভালো লাগতো।
অবশেষে পৌঁছলাম। এদিকে শুধুই পুরোনো চার্চ। খানিক সময় ছবি তুলে উঠে পড়লাম। এবারের গন্তব্য ট্রেন স্টেশন। ফিরতি ট্রেন ধরতে হবে। বাঁধালাম দ্বিতীয় বিপত্তি। অনেকক্ষণ ধরে ম্যাপ স্টাডি করার ফলাফল হল যেখানে দুপুরের খাবার খেয়েছিলাম সেখানেই ফেরত আসলাম। ভাগ্যিস হাতে অনেক সময় ছিল। এইবার হাঁটা বাদ আর হাঁটার মত কোন শক্তিও অবশিষ্ট ছিল না। বাসে চড়ে বসলাম।
স্টেশনে এসে দেখি যেই ট্রেনের টিকিট ছিল সেই ট্রেন আসতে এক ঘন্টা দেরি হবে। গেলাম কাউন্টারে, ২০ মিনিট পরের ট্রেনে টিকিট পরিবর্তন করে নিতে কারণ ওটা ঠিক সময়েই আসবে। কাউন্টার থেকে বলা হল চেঞ্জ করার জন্য যেই ট্রেনে করে এসেছি সেটার টিকিট লাগবে। ব্যাগের আর নিজের দেহের চিপায়-চাপায় খুঁজেও যখন পেলাম না তখন নিজেকে গালি দেওয়ার শক্তিটুকুও নেই।
প্রায় ১০ মিনিট পরে হঠাৎ করেই 'ইউরেকা, ইউরেকা' বলে লাফিয়ে উঠলাম। টিকিট রাখা ছিল জ্যাকেটের গোপন পকেটে যেটার কথা আমিই ভুলে বসে ছিলাম। টিকিট চেঞ্জ করে ঠিক সময়মতন উঠে বসলাম মালাগার ফিরতি ট্রেনে।
এখানেই শেষ নয়। ফেরার পর মালাগার শপিং মলগুলো খানিক ঘুরে যখন ঠিক করলাম এইবার বাড়ির পথ ধরি আর বাস স্টপ খুঁজে পাই না। যেগুলো পাই সেগুলো থেকে ঐদিকে কোন বাস যায় না। আমার কোন দোষ নাই। এর কারণ স্পেনের অনেক রাস্তাতেই একদিকে চলাচল। যার ফলে বাস যেদিক থেকে আসে, সেদিক থেকে নাও যেতে পারে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে পেলাম। আর সেই বাস ঘন্টায় একটা।
আপনাদের আর বসিয়ে রাখবো না আমার সাথে। আমিও এত্তকিছুর পরে অনেক ক্লান্ত। সাথে আনা নাপা খুব কাজে দিচ্ছে। মালাগার গল্পই তো শোনানো হল না। হবে আরেকদিন। আজ যাই।
--------------------
গ্রানাডা থেকে
রাত ১০টা ৩০
২৯ ডিসেম্বর
নয় বছর আগে বাবাকে যেভাবে হারাই
২ মাস আগে