বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

আমি আর সিএসই'১২

১৪ বছর বেশ লম্বা একটা সময়। 
২০০১ সালের জানুয়ারি মাস। কোন এক শীতের সকালে আইইউটিতে ভর্তি হলাম। সেই শুরু। আর আজ শেষ।
২০০৪ এর শেষ দিক পর্যন্ত ছাত্র আর তারপরই জীবনের প্রথম চাকরি আইইউটিতেই। সময় কত দ্রুত চলে যায়। আজ ২০১৪। শিক্ষকতা জীবনেরও দশ বছর পার হয়ে গেছে। তবে এর ভেতর ছয় বছরই ছিলাম বাইরে বাইরে - উচ্চশিক্ষার্থে।
আমার বাবা একজন শিক্ষক ছিলেন। খুলনার এক হাই স্কুলের হেডমাস্টার। তাই শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়াটা মনে হয় প্রকৃতি প্রদত্ত।

একজন শিক্ষকের সবথেকে বড় প্রাপ্তি হতে পারে তার ছাত্রদের শ্রদ্ধা আর অকৃত্রিম ভালোবাসা।

ক'দিন আগেও যখন সিএসই সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস মনিটর ২৫ বলল, স্যার আপনাকে ফেয়ারওয়েল দিতে চাই - আমি ভাবিনি আজ ওরা এরকম কিছু একটা করে বসবে। আমি ভাবিইনি যে ওরা পাঁচ তলা থেকে সিঁড়ির দু'পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে গার্ড অফ অনার দিবে। আমি এতটার যোগ্য নই। ওরা ছোট মানুষ - ওরা এটা বুঝে না যে আমি ওদের জন্য বাড়তি কিছুই করিনি। আমার মেধার পুরোটা দিয়ে পড়ানোটা আমার বদান্যতা বা মহানুভবতা নয় বরং সেটাই আমার কাজ আর ওদের অধিকার।
যাই হোক, ক্লাস রুমে ঢুকেই দেখি ইয়া মস্ত এক কেক। সেখানে আবার শুভকামনার while loop চলছে তো চলছেই। আমি ওদের আন্তরিকতায় মুগ্ধ, আনন্দিত ও কিছুটা স্তম্ভিতও বটে। এরাই তো ওরা না যাদের ল্যাব ক্লাসে আমি ছিলাম মোটামুটিভাবে এক আতংক (আমার মতে)। কোথাও কি ভুল হচ্ছে তবে?
না ওদের ভুল হয়নি হয়ত তবে আমার হয়েছে। ওরা যে আমাকে এতটা ভালবাসে এইটা আমি কখনই বুঝিনি। এখনও বুঝে উঠতে পারছি না। আমি কি সত্যিই এত ভালবাসার যোগ্য? I just did my job and thats it.

আজ আমি আমার পেশাগত জীবনের সবথেকে বড় উপহার পেয়েছি। ছাত্রদের কাছ থেকে সম্মান, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। অদ্ভূত একটা দিন ছিল আজ।

হয়ত এর থেকেও আরও বড় উপহার সামনে অপেক্ষা করছে। যখন দেখবো তোমরা, সিএসই'১২ এর ছেলেরা আমাকে শিক্ষায়, গুণে, মানে ছাড়িয়ে গেছ। আর তারপরও কোথাও দেখা হলে বলবে, স্যার আমি আপনার ২০১৪ সালের আইইউটি সিএসই'র এক পাগল ছাত্র - যে কি না আপনার শত বকাঝকা সত্ত্বেও আপনাকে অনেক পছন্দ করতাম। আমি অপেক্ষায় রইলাম। দেখি, ততদিন পর্যন্ত তোমাদের আইডি মনে থাকে কি না।

বাবা যখন শিক্ষকতা করতেন তখন দেখেছি প্রতি ঈদেই বাবার স্কুলের নাইন-টেনের ভাইয়ারা তাদের স্যারের বাসায় বেড়াতে আসতেন। আর তারপর সেই ছোট্ট আমি ভাইয়াদের সাথে বেড়াতে যেতাম।
আমার ১৮ দিনের পিচ্চি মেয়ে - আরইয়া'র জন্যও কি নিয়তি তা লিখে দিল?

কিছু কিছু চলে যাওয়ায় মায়া বাড়ে। আজ না গেলে আমার সিএসই'১২ এর জন্য মায়াটা বুঝতে পারতাম না মনে হয়।

দেখা আর হোক বা নাই হোক - মায়াটা থাকবে, অনেক অনেক দিন।

শনিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৩

টুকরো সময় ১

একঃ

সন্ধ্যাবেলা। চুপচাপ বাসাটা। সাধারণত এই বাসাতে সন্ধ্যাতেই আড্ডা জমে। আজ জমছে না। বাবা ঘরে বিছানায় বসা। আমি ব্যাগ গুছাই। ফয়সাল মনে হয় ওর ঘরে। শাহান ও তার রুমে। ইমতিয়াজ ও আছে। বাসায় অনেক লোকজন। কিন্তু চুপচাপ। বিদায়বেলায় এটাই হওয়ার নিয়ম।

এরও বেশ কিছু পরে বাশার ভাই আসে। বাশার ভাই ক্যাব চালক। কালো রঙয়ের ক্যাব তার। আমি নেমে আসি সিঁড়ি থেকে। ব্যাগটা বেশ ভারী। বাবা নামে এর পরে। সাথে অন্যরা। বাবা আর আমি বাশার ভাইয়ের ক্যাবে উঠি। আর বাকিরা ইমতিয়াজের সাদা গাড়িতে।

পথে বাবার সাথে আমার খুব বেশি কথা হয় না। বেশি কথা হয় বাশার ভাইয়ের সাথে। বিদায় বেলায় আপনজনদের সাথে কম কথা বলাই ভাল। ছেলে মানুষ ধরা গলায় কথা বলছে শুনতে ভালো লাগে না। আমরা চলে আসি গন্তব্যে।

অনেক ভীড় এখানে। সমসময়ই থাকে। আমরা একটা কোণায় দাঁড়াই। অল্প কিছু কথা হয় সবার সাথে। নীরবতা আর ভাল্লাগছে না। আমি চলে যেতে চাই। বাশার ভাইকে ক্যাবের টাকা দেই। আর বলে দেই যেন বাবাকে ঠিকমত মালিবাগ নামিয়ে দিয়ে আসে।

বাবা যাবার আগে কি বলেছিল মনে নাই। ওরা বলেছিল বেস্ট অফ লাক। আমি কিছু একটা বলি বোধহয়। গলা কেঁপে যায়। আমি পালিয়ে যাই। অনেকদূরে। আপনজনদের কাছে থেকে দূরে। অনেকদূরে।

দুইঃ

আজ খুব ব্যস্ত ছিলাম সারাদিন। বাইরে বেশ শব্দ। আমি ভাগ্যবান। আমার এই রুম ছেড়ে আর অন্য কোথাও যেতে হবে না। চারটা বছর কাঁটিয়ে দিলাম এই রুমেই। আমার ঘামের গন্ধ দেয়ালে মিশে গেছে এই রুমের।

আমি এত শব্দ পাত্তা দেই না। কাজ করতে থাকি। মাঝে ইডার কাছে থেকে বিদায় নিয়ে আসি। ও চলে যাবে দেড়টা বাজলেই। ইডা আমাদের গ্রুপের সেক্রেটারি। বা বলা যায় ইডা আমাদের গ্রুপের অভিভাবক। সকল সমস্যার মুশকিল আসান ইডার জানা আছে।

আমি কাজ করতে থাকি। চারটা বাজার সাথে সাথেই লোকজনের আনাগোনা কমে আসে। আজ শুক্রবার। এই দিনে সবাইই একটু তাড়াহুড়োয় থাকে। আমার কাজ শেষ প্রায়।

ঠিক এইসময় আন্দ্রিয়াস আসে রুমে। আমি ওকে বলি শেষ কাজ। হাত মিলাই আমরা দুজনে। কাল ওর জন্য একটা ব্যাগ কিনে ছিলাম। সেটা দেই। সে বার বার বলতে থাকে এটা কেন করছো? আমি বলি, আমার ভালো লাগবে তাই। তুমি অনেক সাহায্য করছো আমাকে এই ৪ বছর। সে বলে, এটাতো আমার-তোমার দায়িত্ব। আমি বলি, সবাই দায়িত্ব পালন করে না। পালিয়ে যায়। আমার গলা কেঁপে যায় আবার। একটু। ইংরেজী ভুল-ভাল হয়ে যায়। সে হাসে। আমিও হাসি।

আন্দ্রিয়াস চলে যায়। আমি শেষকাজ টুকুতে হাত দেই। তাও হয়ে যায় অল্প সময়েই। এখনকার মত কাজ শেষ। আমি ডেস্ক গুছাই। পরিষ্কার করি। আসার সময় আমার কী-বোর্ড টা নিয়ে আসি। সুভ্যেনির হিসেবেই।

রুমের দরজা আটকে নেম প্লেটে চোখ পড়ে। মায়া পড়ে গেছে এখানে। আমি মায়া কাটানোর চেষ্টা করি।

আমি সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকি। আমার এখানের কাজ শেষ আজকে। থিসিস জমা দিয়ে দিলাম।

আমি এবার আপনজনদের কাছে যাবো। অনেক কাছে। অনেক কাছে।


বৃহস্পতিবার, ২২ মার্চ, ২০১২

আমার অন্যরকম একদিন

দিনের শেষেঃ
এখন কাঁদছি। সশব্দে। নিজের কানেই কিরকম বেসুরো লাগছে। তারপরও কাঁদছি। আর লিখছি। লিখে রাখছি এই দিনটার কথা। বাঙালির আটপৌরে একটা দিনই প্রায়। স্বপ্ন থাকে। স্বপ্ন প্রায় পুরোটা পূরণ হতে গিয়েও হয় না। দিনশেষে প্রাপ্তির খাতা শূন্য। একবারেই শূন্য?


দিনের শুরুঃ

একেবারেই অন্যরকম। সাতটা বাজার আগেই বিছানা ছেড়েছি। ফেসবুকের পাতা আর খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে রেডি। ফুরুফুরে একটা আমেজ। বসন্তকালের সাথে বেশ যায়। আজ বাংলাদেশ ফাইনাল খেলবে। এশিয়া কাপ ফাইনাল। দারুণ খেলেছিল ওরা ভারত, শ্রীলংকার সাথে। পুরো প্রফেশনাল ক্রিকেট। প্রত্যাশা তাই এবার অন্যরকম।

তারপরেঃ

ইউনিতে নিজের রুমে এসে যখন ঢুকি তখনও খেলা শুরু হতে আরও প্রায় ৪৫ মিনিট বাকি। সময়ের ব্যবধানে আমার এখানে খেলা শুরু ৯টায়। কাল রাতের একটা কাজ বাকি ছিল। সেরে ফেললাম চটজলদি। তার আগে ব্রাউজারে ওপেন করে নিলাম ফেসবুক আর ক্রিকইনফো ট্যাব। জানলাম, বাংলাদেশ টসে জিতেছে।

ইনিংস শুরুঃ

একেবারে প্রথম থেকেই দেখেছি। প্রথম বলটা হাফিজ ছেড়ে দিল। সকাল সকাল সিগারেটের তৃষ্ণা পাওয়ায় নিচে গেলাম। রুমে এসে ঢুকতেই দেখি কাভারে রিয়াদ এর ক্যাচ। ১ম উইকেটের পতন। মিউটেড 'ইয়েস' বলেই চেয়ারে বসে পড়লাম আবার। এক মনিটরে খেলা আর অন্য মনিটরে কোড খুলে রাখলাম ক্যামোফ্লেজ হিসেবে।

এরওপরেঃ

মোর্শেদ এসেছিল খানিক পরে। ওর সাথে গল্প আর খেলা দেখতে দেখতেই আরও ২ উইকেট হাপিশ। আমিও খানিক নির্ভার হয়ে ভাবলাম যাই বসের সাথে নিজে থেকেই দেখা দিয়ে আসি। যাতে পরে বিরক্ত না করে।

আধাঘন্টা খানিক পরেঃ

খেলা চলল বাংলাদেশের মত। আর আমার কাজ অনাদরে-অবহেলায় পড়ে রইল ডেস্কটপের এক কোণে। এর ফাঁকে ফাঁকে চলল ফেসবুকিং। যেই বলি 'উইকেট দরকার', আর ওমনি উইকেট। আর কে নেবে? আমাদের সুপারম্যান-আল-হাসান। মাঝে থেকে আফ্রিদি একটু এলোমেলো করে দিল বোলিং। ব্যাপার না। সেও বিদায় নিল ১৮০ এর আগেই।

২০০ তে বুকড?

৬ উইকেট পড়ার পরে ৭, ৮ ও পড়ে গেল টপাটপ। আমি যা বুঝি, ২২০ এর নিচে যে কোন স্কোর বাংলাদেশ অনায়াস দক্ষতায় তাড়া করতে পারবে। আশায় বাঁধিলাম বুক, পাকি হইবে আন্ডার ২০০ বুকড।

হলো নাঃ

৯ উইকেট বাংলাদেশ ফেলেছিল মনে হয় ৪৫/৪৬ ওভারের দিকে। রান তখন ২০৬ এর মত। আমি তখন আরাম করে একটা সিগারেট খাবো ঠিক করছি অল-আউট হলেই। হলো না। পাকি অল-আউট হলো না। শেষ ওভারের খেলা দেখার সময় কল্লোল, মোর্শেদ ও রুমে ছিল। ওদের বলছিলাম রান আর কত হবে? ২২৫? নাহ, রান আরো বেশি হল। ৪৯ ওভার বাংলাদেশের মনমতন খেলা হল। আর শেষ ওভারটা পাকিদের ইচ্ছামতন। আরে, ধূর, এইগুলো ব্যাপার হইল? মজা করে তখন বলেছিলাম, ১০ ওভার কেটে রান ২৫ কমায় দিক। টাইগাররা আরো স্বচ্ছন্দে জিতুক।

বিরতিঃ

বেরিয়ে পড়লাম বাসার উদ্দেশ্যে। ক্যাম্পাসেই থাকি। সাইকেলে ৫ মিনিট। বাংলাদেশের ইনিংসে টেনশন বেশি থাকে। তাই বিড়ি টানতে হয় যেটা বাসায় রুমে বসেই করা যায়। এবং, অতঃপর বেরিয়ে পড়া। বেরিয়েই বুঝলাম, প্রেমে পড় আর নাই বা পড়, এখন বসন্ত। তাপমাত্রা ১৮ এর মতন। হালকা বাতাস। রোদে ঝিকিমিকি সোনালি চুল আর কোমল  ... আচ্ছা, তাড়াহুড়া আছে। বাসায় যাই আগে।

বাংলাদেশঃ

নাজিম একেবারেই ইজি না। আরেক পাশে তামিম কিন্তু দারুণ। গুলের বলে ঐ আপিশ স্ল্যাশটা আরো দারুণ। ইনিংসের প্রথম চার। নাজিম রান না পেলেও উইকেট কামড়ে ছিল। কিন্তু ১০ ওভার পার হওয়ার পরও ... নাহ, হচ্ছে না। আমারও উশখুশ লাগছে।

১৫-৩০ ওভারঃ

গুরুত্বপূর্ণ সময় ইনিংসের। পাকিরা এই টাইমে রানও চেক দিছে আর উইকেটও নিছে। রান মনে হয় এই ১৫ ওভারে হয়েছে ৩৫ এর মত। ৩০ ওভার শেষে ১০০ এর মত। তবে আশার কথা ৭ উইকেট অক্ষত এখনও, সাকিব অক্ষত এখনও।

আমার গল্পঃ

এর পরের কথা আর বলব না। আমি আমার গল্প করি। আমি বিছানায় শুয়ে আরাম করে খেলা দেখতে পারি না। আজকে চেষ্টা করেছিলাম। কাজ হয়নি। ৩২ ওভারের দিকে দেখি আমার সারা শরীর কাঁপছে। নিজের উপরই বিরক্ত হলাম এই হার্ট দেখে। আমি নিজেকে মনে করতাম আমার হৃদয় অনেক বড়। জড়সড় হয়ে এসে বসলাম চেয়ারে। ৯০ বল, ১০৫ রান, সাকিবসহ ৭ উইকেট। হাতের কাছে কোক নিয়ে বসলাম। কেক দিয়ে উদযাপনটার ছকও কেঁটে রাখলাম।

নাসির গেল ১৭০ এ। ব্যাপার না। মুশফিক আছে তো। সাকিব গেল। একটু মিইয়ে গেলাম। মুশিও গেল ১৯০ এ। ফুলস্ক্রীন ছোট করলাম। হতাশ হয়ে সিগারেট ধরালাম। পাঠক জেনে নিবেন এটা অজুহাত মাত্র। মাশরাফি দারুণ খেললো। ফের স্ট্যাটাস 'পাগলা' কে নিয়ে। এভাবেই ১৫ বলে ১৯। ম্যাশ আউট। পরের দুই বল ডট। আমার ছাইদানী প্রায় পূর্ণ। কিন্তু এখন উঠতে পারবো না। ১২ বলে ১৯।

ঐ ১৯ নিয়েছিল পাকিরা শেষ ওভারে। ওটা হয় ক্রিকেটে, আগে ব্যাটিং করলে আরও বেশি হয়। কিন্তু টাইগাররা তো চেজ করছে। প্রেসার আছে। কোন চার-ছয় ছাড়া ৬ বলে ৯ রান। শেষ ওভার করার আগে আমি ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখলাম এইভাবে ... "আমার যেন তোদের মতন ১১ টা ছেলেপুলে থাকে ... "।

এই স্ট্যাটাস টা আমি আর দিতে পারিনি।

কোন স্বপ্ন পূরণের এত কাছে থেকে রিক্ত হাতে ফিরে আসলে কেমন লাগে আমি বলতে পারবো না। সাকিব পারবে। ওকে জিজ্ঞাসা করতে আমার সাহস হয় না। আমি শুধু জানি, আমার আজকের দিনটা একেবারেই অন্যরকম। আজ আমি কেঁদেছি, অনেকদিন পর।

এই কান্নায় অসহায়ত্ব ছিল।

দিনের শেষ ভাগে এসে মনে হচ্ছে, আমি অসহায় নই, আমরা অসহায় নই। আমাদের সাথে ঐ ১১ টা ছেলে আছে যারা প্রায় সবাই আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট কিন্তু তাদের শক্তি, ক্ষমতা অসীম। ওরাই আমাকে আজ বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তুলছে।

আবারও অন্যরকম একদিনের অপেক্ষায় রইলাম। কাঁদবো আবারও তবে বিজয়ের কান্না।

শুভ রাত্রি।

শনিবার, ২৫ জুন, ২০১১

চলিতে চলিতে থেমে যায় - ৩

সুখী হওয়ার জন্য কী লাগে? কালো টাকা, সাদা টাকা? গাড়ী-বাড়ী-নারী?

খুব বেশি দিন হয়নি শেষবার যাওয়ার। আবার যাচ্ছি। এই ক'দিন আকন্ঠ কাজে ডুবেছিলাম। টের পাইনি। দেশে যাওয়ার দিন এখন এত্ত কাছে। এই যে যাবো দেশে, এই চিন্তা করেই আমি এখন মস্ত সুখী। গলা ছেড়ে গান গাইছি। রাতের বেলা সাইকেল নিয়ে পাড়া মহল্লায় ঘুরছি আর চিৎকার করছি। সুখী হওয়ার জন্য আসলে তেমন কিছুই লাগে না, শুধু নিজের ইচ্ছেটা থাকলেই হয়।

প্রতিদিন খবর নেই। দেশে গরম কতটা। কলিগরা জানতে চায় ওয়েদার কী রকম। বলি, হট অ্যাণ্ড হিউমিড। কই, তারপরওতো এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এই হট অ্যাণ্ড হিউমিডের মধ্যে যখন দাঁড়াবো তখন তো ঠিকই মনটা জুড়িয়ে যাবে।

দেশে যেয়ে প্রথম কথা হয় কার সাথে বলবো? সিএনজি চালক মামার সাথে। আমি কখনও মামাদের সাথে বেশি কথা বলি না। শুধু এই একটা সময় বাদে। অনেক কথা বলি এবং সিগারেট অফার করি। তারপর সিএনজি যেয়ে প্রথমে থামে একটা মানি এক্সচেঞ্জের কাছে। পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে পরের গন্তব্য ... পুরো ঢাকা।

তার কিছুক্ষণ পরে হয়ত পরিপাটি আমি বের হয়ে যাবো ঢাকার রাস্তায় রাস্তায়। আর সন্ধ্যারও পরে যখন ফিরবো তখন চুল হয়ত ভিজে হয়ে থাকবে ঘাম আর জেল একত্রে মিশে। টি-শার্টটা আর একবারও পরা যাবে না, না ধুয়ে। ক্লান্ত থাকবো আমি। তারপরও সুখী আমি।

অনেক প্ল্যান থাকে। কোন হোটেলে খাবো, কই কই যাবো, ইত্যাদি ইত্যাদি। সবকিছু কোনবারই করা হয়ে ওঠে না। এই যে, এবার যেয়ে করবো বলে ...

আর মাত্র কিছু দিন, কিছু ঘন্টা। তারপর বাংলাদেশে।

বৃহস্পতিবার, ৯ জুন, ২০১১

৭৩০ তম দিনে

০৯-০৬-২০০৯। নয়-ছয়ের খপ্পড়ে পড়েই কি না জানি না, এই দিনটাতেই এখানে এসে পৌঁছেছিলাম। এনস্কেডে, নেদারল্যান্ডসে। বেশ সকালেই স্কিফলে নেমে ট্রেনের টিকেটটা করে এয়ারপোর্টের বাইরে যেয়েই প্রায় তের ঘন্টা বাদে একটা সিগারেট ধরিয়ে আশেপাশের মানুষ দেখছিলাম। তার খানিক বাদেই পে-ফোন বুথ থেকে বাবাকে ফোন করেছিলাম। তারও বাদে ট্রেনে করে যাত্রার শেষটুকু - এনস্কেডের উদ্দেশ্যে।

ইউনি ক্যাম্পাসে আমার প্রথম বাসাটা ছিল নীচতলায়। আশেপাশে ঝোঁপঝাড়। গ্রীষ্মে একেবারে সবুজ হয়ে থাকত চারপাশ। একটু দূরেই ক্ষীণকায়া জলাশয়। বাসাটার মাঝে বেশ স্বপ্নালু একটা ভাব ছিল। আমার ঐ সময়টায় কিছুটা স্বপ্নের দরকারও ছিল - একেবারেই তখন স্বপ্নহীন ছিলাম বলেই হয়তবা।

বাসাটার সোজাসুজি একটা লম্বা রাস্তা ছিল। রাস্তার চারধারে ছিল অনেক অনেক গাছ। ছায়া দিয়ে রাখত ওরা সবসময়। আমি ঐ রাস্তাটার নাম দিয়েছিলাম 'স্বপ্ন রাস্তা'। আর গাছগুলি ছিল আমার বন্ধুদের মত। বন্ধুরা ছায়া দিয়ে আমাকে আমার স্বপ্নের চৌরাস্তায় পৌঁছে দিয়ে যাবে।

তিন মাসের মাথায় ঐ বাসা ছেড়ে দিয়ে এসেছিলাম আমার এখনকার বাসায়। এই বাসাটা আকাশের কাছাকাছি। পাঁচ তলায়। এখান থেকে আর মাটির ঘ্রাণ পাই না, আকাশের শূন্যতা অনুভব করি। নিজের ভেতরকার শূন্যতাও কী? নিজেকে প্রশ্ন করি না ভয়ে। যদি স্মৃতিগুলোর উপর জমে থাকা ধূলো সরাতে গিয়ে নিজেকেই স্মৃতির অতলে হারিয়ে ফেলি?

এইতো বেশ ভালো আছি। বর্তমানকে আঁকড়ে ধরে। কোন একটা শিশিরভেজা সুন্দর সকালের অপেক্ষায়। কখনও যে আসবেই তা সেই নিশ্চয়তা কী আছে? নাই বা থাকলো। স্বপ্নহীন হয়ে বেঁচে থাকা অনেক বড় কষ্টের।

কত্তগুলো দিন চলে গেল এই প্রবাসে! একা একা। প্রিয়জনদের সান্নিধ্য থেকে অনেক দূরে। মাঝে মাঝে চিন্তা করি; যা হতে চেয়েছিলাম তা কী হতে পেরেছি? অথবা আমি কী আসলেই জানতাম আমি কি হতে চাই? কিংবা হয়ত আমার একা থাকতেই ভালো লাগে। কী জানি!

আর লিখব না। এখন সাইকেল নিয়ে ক্যাম্পাসের চারপাশে ঘুরে বেড়াবো। আমার অনেক প্রিয় একটা কাজ। রাতের নীরবতা আমার নীরবতাকে ম্লান করে দেয়। আমি খুশি হই। আমার থেকেও নিঃসঙ্গ কাউকে অনুভব করতে পেরে।

----------------------
এনস্কেডে থেকে
০৯-০৬-২০১১

বুধবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১০

আন্দালুসিয়া থেকে - ২

টেরই পেলাম না কিভাবে ৩টা দিন চলে গেল। আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, গত তিন দিনের কথা মনে করলেই কোন মূহুর্তটা চোখের সামনে ভাসে তবে আমি বলবো পাহাড়ের ঢাল ধরে কুঁজো হয়ে উপরে উঠছি যেন কোন পরমা সুন্দরী আমার জন্য চূড়ায় বসে অপেক্ষা করছে। সুন্দরী অনেকেই ছিল উপরে তবে তাদের কেউই আমার জন্য ছিল না। আমার জন্য ছিল পুরোনো, শ্যাওলা ধরা দেয়াল আর দেয়ালের ভিতরে আগের দিনের রাজা-বাদশাহদের বাগানবাড়ি আর দূর্গ। আমার কাছে দুধ থেকে ঘোল উত্তম।

২৭ ডিসেম্বরঃ
---------------------------------------------------
এখানে ভোরবেলায় কাক ডাকে কিনা জানি না, তবে আমাকে উঠতেই হল অনেক সকালে। সূর্য তখন উঠি উঠি করছে। ব্যাগপ্যাক কাঁধে আর গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে ঠিক বাস স্টপটাতে গিয়েই দাঁড়ালাম। গন্তব্য ট্রেন স্টেশন। করডোবা যাচ্ছি ট্রেনে।

মালাগা থেকে ১৫০ কিমি দূরত্ব ট্রেনে পাড়ি দিতে সময় লাগে ১ ঘন্টা ১০ মিনিট। ডাচ ট্রেনগুলোর এদের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। আর এই ট্রেনে চড়ে আপনারও কিন্তু ঘুমিয়ে থাকলে চলবে না। চেষ্টা করুন বসতে জানালার পাশে আর চোখ খোলা রাখুন। প্রকৃতি আপনার চোখ জুড়িয়ে দেবে। কিছু'খন পরপরই পাহাড় আর উপত্যকা ধরা দেবে জানালার পাশে। ডিসেম্বরের শেষভাগে এসেও চারদিকে অনেক সবুজ। এবার নিন, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটান আর বলুন দুধ অপেক্ষা ঘোল উত্তম।

 
বেশ বাতাস বইছিল যখন নামি করডোবাতে। ট্রেন স্টেশনের ভিতরেই ট্যুরিসমের কাউন্টার। জেনে নিলাম বাস নম্বর যাওয়ার, করডোবার বিখ্যাত ক্যাথেড্রাল-মস্কে। মুসলিম শাসনাধীন সময়ে এর মূল নির্মাণ আর পরে খ্রিষ্টানরা কর্তৃত্ব নিয়ে সূচনা করে ক্যাথেড্রালের। সামনের চত্বর ঘিরে রয়েছে কমলা বাগান। চটপট কয়েকটা ছবি তুলে টিকিট কেটে ভিতরে এসে ঢুকলাম। সারি সারি, ক্যাথেড্রালের ছাদ ছোঁয়া কারুকর্যময় পিলার আর ততোধিক সুন্দর ক্যাথেড্রালের নকশা-খচিত ছাদ। অনেক প্যাভিলিয়ন আছে ভেতরে। ইতিহাসবিদ নই তাছাড়াও অতীত নিয়ে ঘাটাঘাটি বিশেষ পছন্দ নয় বিধায় আমি শুধু ছবিই তুলে গেলাম। প্রার্থনার মূল বেদীর সামনে যেয়ে চোখ ছানাবড়া। Freaking Gorgeous. একথাটাই বলে ছিলাম তখন। এরপরে আরো অনেকবারই বলেছি মনে হয়।



পুরো বর্ণনা দিয়ে ঘোলটাকে দুধ বানিয়ে দিতে চাই না। শুধু বলব, একবার ঘুরে আসুন।

ক্যাথেড্রাল থেকে বেরিয়ে গেলাম রোমানদের বানানো এক সেতু দেখতে। সেতুর মাথায় এক বিশাল টাওয়ার যেমনটা দেখতে পাওয়া যায় Age of Empires গেমে। নাম ভুলে গেছি এই প্রাচীন স্থাপত্যের। ধরে নেন টাওয়ার অফ হ্যানয়।


এই ফাঁকেই আবার বেকুব টাইপ একটা কাজ করলাম। বুড়িমতন এক মহিলা আমার দিকে ফুল বাড়িয়ে ধরল। আমি ভাবলাম, তরুণী না হোক অসুবিধা কী; আর তাছাড়া ফুল না নিলে মনে কষ্ট পাবেন। এই ভেবে যেই হাত বাড়ালাম উনি খপ করে আমার হাত ধরে ভাগ্য গণনা শুরু করে দিলেন। প্রথমেই বললেন আমি খুব বুদ্ধিমান; আমি মনে মনে বলি, "হ। খুউব বুদ্ধিমান। তাইতো এখন আমার হাত তোমার কাছে"। শুধু ভালো ভালো কথাই শুনলাম। খারাপ কিছু বলল না। পাঁচটি ইউরো খসে গেল।

করডোবার রাস্তাগুলো আমাদের পুরোনো ঢাকার রাস্তার থেকেও সরু। ঐ গলিগুলোতে আবার গাড়িও যায়। এরকম চিপা চাপায় ঘুরতে থাকলাম। খিদে মেটালাম পায়েইয়া (বাঙালী উচ্চারণঃ পায়েলা) খেয়ে। তারপর ঠিক করলাম শহরের অন্য প্রান্তে যাবো। ওলা বলে লোক থামানো শুরু করলাম। সবার এক কথা "তরেতো", মানে সোজা রাস্তায় যাও। যেতে যেতে ভাবতে থাকলাম পা দুটো খুলে হাতে নিয়ে হাঁটতে পারলে ভালো লাগতো।

অবশেষে পৌঁছলাম। এদিকে শুধুই পুরোনো চার্চ। খানিক সময় ছবি তুলে উঠে পড়লাম। এবারের গন্তব্য ট্রেন স্টেশন। ফিরতি ট্রেন ধরতে হবে। বাঁধালাম দ্বিতীয় বিপত্তি। অনেকক্ষণ ধরে ম্যাপ স্টাডি করার ফলাফল হল যেখানে দুপুরের খাবার খেয়েছিলাম সেখানেই ফেরত আসলাম। ভাগ্যিস হাতে অনেক সময় ছিল। এইবার হাঁটা বাদ আর হাঁটার মত কোন শক্তিও অবশিষ্ট ছিল না। বাসে চড়ে বসলাম।

স্টেশনে এসে দেখি যেই ট্রেনের টিকিট ছিল সেই ট্রেন আসতে এক ঘন্টা দেরি হবে। গেলাম কাউন্টারে, ২০ মিনিট পরের ট্রেনে টিকিট পরিবর্তন করে নিতে কারণ ওটা ঠিক সময়েই আসবে। কাউন্টার থেকে বলা হল চেঞ্জ করার জন্য যেই ট্রেনে করে এসেছি সেটার টিকিট লাগবে। ব্যাগের আর নিজের দেহের চিপায়-চাপায় খুঁজেও যখন পেলাম না তখন নিজেকে গালি দেওয়ার শক্তিটুকুও নেই।

প্রায় ১০ মিনিট পরে হঠাৎ করেই 'ইউরেকা, ইউরেকা' বলে লাফিয়ে উঠলাম। টিকিট রাখা ছিল জ্যাকেটের গোপন পকেটে যেটার কথা আমিই ভুলে বসে ছিলাম। টিকিট চেঞ্জ করে ঠিক সময়মতন উঠে বসলাম মালাগার ফিরতি ট্রেনে।

এখানেই শেষ নয়। ফেরার পর মালাগার শপিং মলগুলো খানিক ঘুরে যখন ঠিক করলাম এইবার বাড়ির পথ ধরি আর বাস স্টপ খুঁজে পাই না। যেগুলো পাই সেগুলো থেকে ঐদিকে কোন বাস যায় না। আমার কোন দোষ নাই। এর কারণ স্পেনের অনেক রাস্তাতেই একদিকে চলাচল। যার ফলে বাস যেদিক থেকে আসে, সেদিক থেকে নাও যেতে পারে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে পেলাম। আর সেই বাস ঘন্টায় একটা।

আপনাদের আর বসিয়ে রাখবো না আমার সাথে। আমিও এত্তকিছুর পরে অনেক ক্লান্ত। সাথে আনা নাপা খুব কাজে দিচ্ছে। মালাগার গল্পই তো শোনানো হল না। হবে আরেকদিন। আজ যাই।

--------------------
গ্রানাডা থেকে


রাত ১০টা ৩০
২৯ ডিসেম্বর

সোমবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১০

আন্দালুসিয়া থেকে - ১

কিছুটা ঝোঁকের মাথায় এক রাতের মাঝেই সবকিছু ঠিক করে ফেললাম। কিছুটা অভিমান থেকে কী কারো প্রতি? হয়তো বা হয়তো নয়। সে যাই হোক, এখন শুনেন সেই গল্প। এই যে, তোমাকেও বলছি; শোন।

বড়দিনের ছুটিতে স্পেনের দক্ষিণভাগে যাবো। ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেঁষা মালাগা থেকেই শুরু করবো আন্দালুসিয়া ভ্রমণ। আন্দালুসিয়া স্পেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। অষ্টম থেকে পঞ্চদশ শতকের প্রায় শেষ পর্যন্ত এই অঞ্চলের অনেকখানিই ছিল মুসলিমদের শাসনাধীন।

২৬ তারিখে যাত্রা শুরু, আইন্দহোফেন থেকে। আমি চলে এসেছিলাম এক দিন আগেই। তানবীরা আপুর একমাত্র কন্যা ও সন্তান আমাদের মেঘলা মা'র জন্মদিন পালন করতে। রাতটা আপুর বাসাতেই কাটিয়ে, সকালের ভরপেট নাস্তা আর দুপুরে বিরিয়ানী খেয়ে যখন বের হলাম তখন একটা চকচকে দুপুর চারদিকে সোনা রোদ ছড়িয়ে দিচ্ছে। সত্যি বলতে এই দেশে, এই সময় এরকম ঝলমলে দিন সোনার মতই দামী।

আমি প্রায়ই হালকা বেকুব টাইপ কাজ করি। এবারও তার ব্যত্যয় হলো না। রাস্তার যে পাশ থেকে বাসে ঊঠতে হবে সে পাশে না যেয়ে বিপরীত পাশে চলে গেলাম। অবশ্য খুব সহসাই ভুল বুঝতে পেরে আবার বাক্স-পেটরা নিয়ে ওপারে। এরপরে এয়ারপোর্টে এসে বাকি সব কাজ সহজেই হলো। ভয় ছিল ক্ষীণ মনে আবহাওয়ার কারণে। কিন্তু এমন চমৎকার একটা দিনের কারণে আকাশে উড়লাম ঠিক সময়েই ট্রান্সাভিয়ায় চড়ে।

কিছুটা ঘুম আর বাকিটা সময় টয় স্টোরি ৩ দেখতে দেখতেই পার হয়ে গেলো। পৌঁছে গেলাম মালাগায় নির্ধারিত সময়ের প্রায় ২০ মিনিট আগেই।

এয়ারপোর্টের বিপরীতেই ট্রেন স্টেশন। আমি যেই হোস্টেলে উঠেছি সেখানে ট্রেন-বাসে করেও যাওয়া যায়। আবার এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি বাসও আছে। প্রথমে ট্রেন আর বাসে করে গেলে অবশ্য হোস্টেলের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া যায়। তাই ট্রেনের টিকিট কেটে অপেক্ষা করতে লাগলাম এবং ট্রেন আসার ঠিক এক মিনিট আগে শুনতে পেলাম লাউড স্পীকারে অবশ্যই স্পেনিশ ভাষায় এক ঘোষণা। এই ক্রিয়ার বিপরীত প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখলাম লোকজন সবাই ট্রেন স্টেশন ছেড়ে বাসের দিকে হাঁটা দিল। একজনকে 'ওলা' বলে থামিয়ে ইংরেজীতে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলাম সাময়িক কিছু সময়ের জন্য ট্রেন যাবে না ওদিকে। সুতরাং, বাসই ভরসা এখন।

বাস যেখানে নামিয়ে দিল জায়গাটার নাম 'পাসেও দেল পার্কে'। কিভাবে হোস্টেলে পৌঁছতে হবে এখান থেকে সেই নির্দেশনা আছে কিন্তু কোন ম্যাপ নেই। একজন চমৎকার ভদ্রমহিলাকে থামিয়ে প্রথমে কোন দিকে যেতে হবে জেনে নিলাম। আর তাকে দিলাম পুরোটুকু 'গ্রাসিয়াস'।

এরপরে চলতে চলতেই একসময় পেয়ে গেলাম 'পিকাসা'স কর্ণার'। এখানেই কাটবে আমার আগামী তিনটা রাত। রিসেপশনে বসা 'দিমি' রুম বুঝিয়ে দিল আর তার পাওনা টাকাও বুঝে নিল। একজনের ছোট্ট, ছিমছাম রুম। তবে শব্দ অনেক কারণ একেবারেই সদর দরজার গা ঘেঁষে বলে।

একটু হাত-মুখে পানি দিয়েই বেরিয়ে পড়লাম চারপাশটা দেখতে। দারুণ আবহাওয়া। তাপমাত্রা ১২-১৫ এর মধ্যেই হবে মনে হয়। হালকা ঝিরিঝিরি বাতাস আর তার সাথে ঝিলমিল করতে থাকা বালিকারা ভ্রমণের ক্লান্তিকে দূর করে দিল প্রায়। প্রায় লিখলাম একটা কারণে। সভ্য সমাজে প্রকাশ্যে বলা যাবে না। প্রাইভেটে আসেন, বলব; তবে এখানেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে।

হোস্টেল থেকে একেবারে কাছেই একটা ঢাল ধরে হাঁটতে হাঁটতেই চোখে পড়ল উঁচু উঁচু দেয়াল। বুঝে গেলাম এই হল 'আল-কাজাবা'। একাদশ শতাব্দীতে মুসলিম শাসকদের নির্মিত এক দুর্গ। ভিতরের ছবি ইন্টারনেটে দেখেছি। রাত হয়ে যাওয়ায় এখন আর ঢুকতে পারলাম না। দিনের বেলা কোন একদিন আসতে হবে।



আল কাজাবার পাশ দিয়ে পাহাড়ের ঢালে উঁচু-নিচু হয়ে চলে গেছে দেয়ালসহ এক লম্বা রাস্তা। আল-কাজাবাকে শত্রুদের হাত থেকে সুরক্ষিত করতেই তৎকালীন গ্রানাডার শাসক ইউসুফ বানিয়েছিলেন এই পথ যার নাম 'জিব্রালফারো'। মাঝেমাঝে থেমে বন্দী করে নিলাম পাহাড়ের উপর থেকে দেখা শহরটাকে। শুনেছি এই পথের কোন এক প্রান্তেই আছে এক বাতিঘর। আজ অতদূর যাইনি; যেতে হবে পরে একদিন।



ঘুরতে ফিরতেই দেখছিলাম অনেকগুলো দলকে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে অথবা হয়তো শুধু দু'জন আলাদা হয়ে যেয়ে আলো-আঁধারীতে বসে আছে। ছায়া পড়েনি ওদের আলাদা করে মাটিতে। আমি অন্যদিকে তাকিয়ে হেঁটে যাই আর ওরা আরও ঘন হয়ে আসে একজন অন্যজনের দিকে। পৃথিবী এক নিষ্ঠুর জায়গা।

কাল সকালে যাবো করডোবা। মালাগা থেকে দেড় ঘন্টার ট্রেন যাত্রা। ওখানেও শুনেছি আছে রোমান আর মুসলিমদের অনেক স্থাপত্য নিদর্শন। সাথে থাকুন, ঘুরে আসি চলুন কাল করডোবা থেকে।


.................................
মালাগা থেকে
রাত ১টা ২০
২৭ ডিসেম্বর, ২০১০